ফলমুখী বা উদ্দেশ্যমুখী নৈতিক মতবাদের বিষয়
ফলমুখী বা উদ্দেশ্যমুখী নৈতিক মতবাদ
আধুনিক নীতিবিদরা নৈতিকতার ক্ষেত্রে দুটি বিকল্প নীতিতত্ত্বের উল্লেখ করেছেন। এই দুটি নীতিতত্ত্বের একটি হল-উদ্দেশ্যমুখী বা ফলমুখী নৈতিক নিয়ম (Teleological Theory) এবং অপরটি হল-কর্তব্যমুখী নৈতিক নিয়ম (Deontological Theory)। এই দুটি নৈতিক নিয়ম পারস্পরিকভাবে বিরুদ্ধ স্বভাবসম্পন্ন। স্বাভাবিকভাবে তাই উল্লেখ করা যায় যে, এই দুটি নৈতিক নিয়মের ওপর নির্ভর করে, উদ্দেশ্যমুখী নৈতিক মতবাদ এবং কর্তব্যমুখী নৈতিক মতবাদ-এর যে উদ্ভব হয়েছে, সেগুলিও পারস্পরিকভাবে বিরুদ্ধধর্মীরূপে গণ্য।
আরও পড়ুন – একাদশ শ্রেণি দর্শন পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা পর্ব ২
উদ্দেশ্যমুখী নৈতিক মতবাদ অনুসারে দাবি করা হয় যে, মানুষের ঐচ্ছিক কর্মের পিছনে যে কর্মনীতি উপস্থিত থাকে, তার ফল বা উদ্দেশ্য যদি ভালো হয়, তাহলে ওই কর্ম বা কর্মনীতিকে নৈতিকরূপে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ বলা যায় যে, কর্ম বা কর্মনীতির ফল বা উদ্দেশ্যের ভালোর ওপরই কর্ম বা কর্মনীতিটির ভালোত্ব নির্ভরশীল। এরূপ মতবাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই উল্লেখ করা যায় যে, এক্ষেত্রে কোনো কর্ম বা কর্মনীতির নিজস্ব বা স্বকীয় কোনো মূল্য নেই। এক্ষেত্রে কর্ম বা কর্মনীতির মূল্যটি হল পরকীয়। কারণ, কর্ম বা কর্মনীতির মূল্য নির্ভর করে, তার ফল বা পরিণামের মূল্যের ওপর।
সে কারণেই বলা যায় যে, এই উদ্দেশ্যমুখী বা ফলমুখী নৈতিক মতবাদে কোনো কর্ম বা কর্মনীতিকে ভালো বলা যায় যদি এবং কেবল যদি তা অকল্যাণ অপেক্ষা কল্যাণের দল বা পরিমাণকে বেশি করে সূচিত করেন। অপরদিকে বলা যায় যে, কর্ম বা কর্মনীতির ফল বা পরিণাম যদি কল্যাণ অপেক্ষা অকল্যাণকে বেশি করে সূচিত করে, তবে তা মন্দরূপে গণ্য হয়। স্বাভাবিকভাবেই তাই বলা যায় যে, ফল বা পরিণতির পরিপ্রেক্ষিতেই কোনো কর্ম বা কর্মনীতিকে ভালো অথবা মন্দরূপে গণ্য করা হয়। কোনো কর্ম বা কর্মনীতি তাই কখনোই নিজে গুণে সৎ বা ভালো নয়।
উদ্দেশ্যবাদীরা তাই দাবি করেন যে, সেই কাজই আমাদের করা উচিত-যা ফলাফল বা পরিণামে ভালো কিছুকে নির্দেশ করতে পারে। সে কারণেই উদ্দেশ্যবাদীরা দাবি করেন যে, আমাদের শুধু সেই কাজই করা উচিত অথবা সেই কর্মনীতিকেই অনুসরণ করা উচিত-যা অকল্যাণ বা অহিত থেকে অহিত থেকে বেশি কল্যাণ বা হিত উৎপাদন করতে পারে।
দ্বিবিধ তত্ত্বে উদ্দেশ্যমুখী মতবাদ
কল্যাণ বা হিতসাধনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সংগতভাবেই একটি প্রশ্ন ওঠে আসে এবং তা হল আমাদের কার হিতসাধন তথা মঙ্গলসাধন করা উচিত? এরূপ প্রশ্নের উত্তর প্রসঙ্গে উদ্দেশ্য তথা ফলবাদীরা কখনোই ঐক্যমত পোষণ করেন না। এঁদের মধ্যে তাই এ বিষয়ে মতভেদ দেখা যায়। এরূপ নৈতিক প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতেই মোটামুটিভাবে দুটি মতবাদ উঠে এসেছে। এই দুটি মতবাদের একটি হল নৈতিক আত্মবাদ (Ethical Egoism) এবং অপরটি হল পরসুখবাদ বা সর্বসুখবাদ তথা উপযোগবাদ (Utilitarianism)।
নিজের সুখে নৈতিক আত্মবাদ
নৈতিক আত্মবাদ অনুসারে দাবি করা হয় যে, আমাদের প্রত্যেকেরই নিজের সুখকেই সর্বাধিকভাবে উৎপন্ন ও কামনা করা উচিত। অর্থাৎ বলা যায় যে, আমাদের নিজের হিতসাধনই হল একমাত্র কাম্য, অপরের হিতসাধন নয়। সে কারণেই এরূপ মতবাদে দাবি করা হয় যে, আমাদের সেই কর্ম বা কর্মনীতিকেই যথোচিত বা ভালো বলা যাবে যদি এবং কেবল যদি তা কর্মকর্তার অকল্যাণ অপেক্ষা বেশি হিতসাধনে সমর্থ হয়। আর তা অনুচিত বা মন্দরূপে গণ্য হবে যদি কর্মকর্তার হিত বা মঙ্গল অপেক্ষা বেশি অহিত বা অকল্যাণসাধনে সমর্থ হয়। আত্মসুখবাদের সমর্থকরূপে উল্লেখ করা যায়-প্রাচীন গ্রিস-এর এপিকিউরাস (Epicurus), অ্যারিস্টিপাস (Aristippus), প্রখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক টমাস হবস Thomas Hobbes) এবং অস্তিত্ববাদী দার্শনিক নিশে (Nietzsche) প্রমুখের নাম। এঁরা সকলেই মনে করেন যে, মানুষের নিজের মঙ্গল তথা হিতসাধনের চিন্তা করা উচিত।
অপরের সুখে পরসুখবাদ বা উপযোগবাদ
পরসুখবাদ তথা উপযোগবাদ অনুসারে দাবি করা হয় যে, ব্যক্তির নিজের সুখ কামনা না-করে, অপর সকল ব্যক্তিদেরই সুখ বা মঙ্গলকামনা করা উচিত। সকল ব্যক্তি বা মানুষের হিত তথা মঙ্গলসাধনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে এরূপ মতবাদকে বলা হয় সর্বসুখবাদ বা পরসুখবাদ (Altruistic Hedonism)। এরূপ মতবাদটিকেই মিল ও বেন্থামের ভাষায় উল্লেখ করা হয় উপযোগবাদ (Utilitarianism) রূপে। এরূপ মতবাদে দাবি করা হয় যে, উপযোগিতার (Utility) নিরিখেই কোনো কর্মকে অথবা কর্মনীতিকে নৈতিকরূপে অথবা অনৈতিকরূপে গণ্য করা হয়।
অর্থাৎ বলা হয় যে, কোনো কর্ম বা কর্মনীতি যথোচিত বা ঠিকরূপে গণ্য হয় একমাত্র তখনই যদি এবং কেবল যদি তা সর্বসাধারণের অকল্যাণ অপেক্ষা বেশি কল্যাণ তথা হিতসাধনে সমর্থ হয়। এরূপ মতবাদে তাই সামগ্রিক হিত বা কল্যাণের ওপরই সর্বশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিপরীতভাবে তাই বলা যায় যে, কোনো কর্ম বা কর্মনীতি সামগ্রিকভাবে সর্বসাধারণের হিতসাধনে ব্যর্থ হয় এবং বেশি করে অকল্যাণ আনয়ন করে, তবে সেই কর্মকে বলা হয় অনুচিত কর্ম বা মন্দ কর্ম। উপযোগবাদের মুখ্য প্রচারক ও সমর্থকরূপে উল্লেখ করা যায় সুখবাদী মিল (Mill) ও বেন্থাম (Bentham)-এর নাম। মিল এবং বেন্থাম ছাড়াও উপযোগবাদের আরও দুজন গুরুত্বপূর্ণ সমর্থক হলেন-ম্যুর (Moore) এবং র্যাশডল (Rashdall)।
ফলমুখী নৈতিক মতবাদরূপে উভয় মতবাদ
ফলমুখী তথা উদ্দেশ্যমুখী নৈতিক মতবাদরূপে নৈতিক আত্মবাদের কথা যেমন বলা যায়, তেমনই আবার উপযোগবাদের কথাও বলা যায়। এই দুটি মতবাদই ফলমুখী তথা উদ্দেশ্যমুখীরূপে গণ্য হলেও, এ দুটি মতবাদ কিন্তু চত্রিগতভাবে দুটি প্রান্তে অবস্থান করে। কারণ, আত্মসুখবাদ নিজের সুখের কথা বললেও, উপযোগবাদ অপর সকলের সুখের কথাই ব্যক্ত করে। অনেক নীতিবিজ্ঞানী তাই এই দুটি প্রান্তীয় মতবাদের মধ্যবর্তী স্তরে এক ধরনের ফলমুখী নৈতিক মতবাদের উল্লেখ করেছেন। এই মধ্যস্তরীয় মতবাদ অনুসারে দাবি করা হয় যে, ব্যক্তির নিজের হিত নয়, অথবা অপর সকলের হিত নয়, ব্যক্তির কামনা করা উচিত তার পরিবারের, দলের অথবা জাতির হিত।
এরূপ নীতির পরিপ্রেক্ষিতে তাই দাবি করা যায় যে, একমাত্র সেই কর্ম বা কর্মনীতিকেই যথোচিত বা ভালো বলা যায় যদি এবং কেবল যদি তা কোনো পরিবারের বা দলের অথবা কোনো জাতির অমঙ্গল অপেক্ষা অধিক মঙ্গলসাধনে সমর্থ হয়। যদি তা সমর্থ না হয়, তবে তা অনুচিত বা মন্দ বলে বিবেচিত হয়। মিল এবং বেন্থামকে অনেক ক্ষেত্রেই এরূপ মতবাদের সমর্থকরূপে গণ্য করা হয়।
1 thought on “ফলমুখী বা উদ্দেশ্যমুখী নৈতিক মতবাদের বিষয়টিকে সংক্ষেপে উল্লেখ করো”